প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস ।

 প্রকৃতির সঙ্গে বাস করুন

– মোঃ শাহাদৎ হোসেন

মানুষ সভ্যতার উচ্চ শিখরে পৌঁছেছে। প্রযুক্তি, শিল্প এবং বিজ্ঞানের অবদানে জীবন সহজ হয়েছে, কিন্তু এই আরাম ও আধুনিকতার পেছনে আমরা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছি আমাদের আসল পরিচয় — প্রকৃতির সন্তান হওয়ার পরিচয়।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, যখন দূষণ, রোগ, এবং মানসিক চাপ আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে, তখন প্রকৃতির কোলে ফিরে যাওয়াই মানবজাতির টিকে থাকার অন্যতম প্রধান পথ। এবং এটা আজকের সভ্যতায়ও পুরোপুরি সম্ভব — শুধু চাই সচেতনতা এবং সদিচ্ছা।

কেমিক্যাল মুক্ত, প্রকৃতিনির্ভর জীবন: বাস্তব উপায়সমূহ

১. বাসস্থান: টেকসই, পরিবেশবান্ধব ঘর এখন উন্নত বিশ্বে "Eco-friendly Homes" বা "Green Building" ধারণা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাঁশ, মাটি, পাটের তৈরি ইট (Compressed Earth Blocks), সোলার প্যানেল ইত্যাদি ব্যবহার করে আধুনিক অথচ প্রকৃতি-ঘনিষ্ঠ ঘর বানানো হচ্ছে।

ছাদে বাগান, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক বায়ু চলাচলের জন্য খোলামেলা নকশা — এই সবই এখনকার বাস্তবধর্মী উদ্যোগ।

২. খাদ্য: নিজের উৎপাদিত বা স্থানীয় জৈব খাদ্য বিশ্বজুড়ে এখন "Urban Farming" বা শহুরে কৃষি আন্দোলন চলছে। ছাদ, বারান্দা বা সামান্য জমিতেই আমরা কীটনাশক ও রাসায়নিক মুক্ত শাকসবজি, ফল উৎপাদন করতে পারি। স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে অর্গানিক খাবার সংগ্রহ করাও সহজলভ্য হয়েছে।

সুস্থ শরীরের জন্য প্রয়োজন প্রকৃতির কোলে জন্ম নেয়া বিশুদ্ধ খাদ্য।

৩. স্বাস্থ্যসেবা: প্রাকৃতিক চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা চিকিৎসা ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় রাসায়নিক ও ওষুধের পরিবর্তে এখন আবার হার্বাল মেডিসিন (ভেষজ চিকিৎসা) জনপ্রিয় হচ্ছে। নিম, তুলসী, অ্যালোভেরা, হলুদ ইত্যাদি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হতে পারে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভেষজ পথ্য ব্যবহার আজকের সভ্যতার মধ্যেও পুরোপুরি সম্ভব।      

৪. পোশাক: প্রাকৃতিক তন্তুর ফিরে আসা বিশ্বের ফ্যাশন জগতে আজ সাস্টেইনেবল ফ্যাশন (Sustainable Fashion) এক নতুন বিপ্লব। সুতি, পাট, খাদি, বাঁশের তন্তু ইত্যাদি দিয়ে তৈরি পোশাক এখন স্টাইল এবং সচেতনতার প্রতীক। এভাবে কৃত্রিম রাসায়নিক রঙ ও কাপড়ের ব্যবহার হ্রাস পাচ্ছে।

৫. সৌন্দর্যচর্চা: প্রকৃতির হাত ধরে সৌন্দর্য চর্চায় রাসায়নিক প্রসাধনীর বিকল্প হিসেবে প্রকৃতির উপহার ব্যবহার করার চল এখন ব্যাপক। নিমপাতা, অ্যালোভেরা, মুলতানি মাটি, কাঁচা দুধ ইত্যাদি দিয়ে ত্বক ও চুলের পরিচর্যা করা আজকের আধুনিক শহরেও বাস্তব।

৬. জ্বালানি: নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বিশ্বের বড় শহরগুলো এখন সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি এবং বায়োগ্যাসের দিকে ঝুঁকছে। সৌরপ্যানেল এখন সহজলভ্য ও কার্যকর, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও সৌরবিদ্যুৎ চালু হচ্ছে। এভাবেই জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষতিকর নির্ভরতা কমানো সম্ভব।

৭. প্রতিদিনের জীবনে ছোট ছোট পরিবর্তন রাসায়নিক ক্লিনার বাদ দিয়ে ভিনেগার ও বেকিং সোডা দিয়ে ঘর পরিষ্কার করা, প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করা, রাসায়নিক সুগন্ধি বাদ দিয়ে প্রাকৃতিক তেল (লেবু, ল্যাভেন্ডার) ব্যবহার করা —

এই সব ছোট ছোট পদক্ষেপও আমাদের প্রকৃতির সাথে জীবনকে জড়িয়ে নিতে সাহায্য করে। 

কেন এটি সভ্যতার মধ্যেও সম্ভব? আজকের সভ্যতা আমাদের কাছে প্রযুক্তি দিয়েছে, কিন্তু সেই প্রযুক্তি ব্যবহারের উপায়ও আমাদের হাতে। যদি আমরা সচেতন হই, তবে প্রযুক্তিকে প্রকৃতির বন্ধু বানানো যায় — শত্রু নয়। উন্নত প্রযুক্তি যেমন সৌরবিদ্যুৎ, রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং, অর্গানিক সার উৎপাদন, ন্যাচারাল প্রসেসিং ফ্যাক্টরি ইত্যাদি এখন বাস্তবে হচ্ছে এবং আরও হবে।

সবচেয়ে বড় কথা, প্রকৃতির সঙ্গে বাস মানে পশ্চাদপসরণ নয় — বরং তা হলো সুস্থ, সমৃদ্ধ ও টেকসই জীবনের দিকে এগিয়ে চলা। 

শেষ কথন 

প্রকৃতি আমাদের জননী। তার ছায়া থেকে দূরে গিয়ে আমরা কখনোই সুখী হতে পারি না।

আসুন, আজ থেকেই ছোট ছোট পরিবর্তন শুরু করি — আমাদের ঘর, খাদ্য, পোশাক, চিকিৎসা সবকিছুতে প্রকৃতিকে আবার ফিরিয়ে আনি।

নিজেকে পরিবর্তন করুন, পৃথিবী বদলে যাবে। প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে গড়ে তুলুন একটি সুন্দর, সুস্থ, সচেতন সভ্যতা।

– মোঃ শাহাদৎ হোসেন

Comments

Popular posts from this blog

আত্মবিশ্বাস ও সফলতা

মানব জনমের স্বার্থকতা